
এইত। আর কিছুক্ষণ পরেই পর্দা উঠবে ক্লাব ফুটবল মৌসুমের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ম্যাচের। জ্বি, আমি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের কথাই বলছি। জার্মানির বার্লিনে যে লড়াইয়ে মুখোমুখি হবে স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনা ও ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাস। দুই দলই লড়বে সম্মানজনক ট্রেবল নিশ্চিত করতে। লা লিগা ও কোপা দেল রে জেতা বার্সা ও কোপা ইতালিয়া ও সিরি আ জেতা জুভেন্টাস উভয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতে পূর্ণ করতে চায় ট্রেবল। আজ রাত ১২.৪৫ মিনিটে শুরু হতে যাওয়া এই মহারণে কেউ সাপোর্ট করবে বার্সাকে, কেউ জুভকে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন যারা থাকবেন অত্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে। যারা বার্সেলোনা ও জুভেন্টাস উভয় ক্লাবেই খেলে গেছেন। তো চলুন দেখে নেওয়া যাক এই পর্যন্ত কতজন খেলোয়াড় খেলেছেন বার্সেলোনা ও জুভেন্টাস উভয় ক্লাবেই!
ড্যানিশ ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা মাইকেল লাউড্রপ। ১৯৮২ সালে ড্যানিশ প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার হবার পর ড্যানিশ ফুটবলে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হিসেবে ১ মিলিয়ন ইউরোতে ট্রান্সফার হন ব্রন্ডবাই থেকে জুভেন্টাসে। কিন্তু তখন প্রতি ক্লাবে সর্বোচ্চ দুইজন বিদেশী খেলার নিয়ম থাকার ফলে প্রথম দুইবছর ভাড়ায় (!) লাউড্রপকে লাজিওতে খেলতে পাঠায় জুভেন্টাস, কারণ তাদের দলে তখন মিশেল প্লাতিনি ও জবিগনেউ বোনিয়েক ছিলেন। দুই বছর পর জুভেন্টাস যখন লাজিও থেকে জুভেন্টাসে ফিরলেন, এসেই জিতলে সিরি আ ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ট্রফি। আবারও জিতলেন ড্যানিশ প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার ট্রফি। কিন্তু জুভেন্টাসে তাঁর সাফল্য বলতে এতটুকুই। প্লাতিনি যতদিন জুভেন্টাসে ছিলেন, প্লাতিনির ছায়া হয়ে ছিলেন, প্লাতিনি অবসর নেওয়ার পরেও জুভেন্টাসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি লাউড্রপ। তাই ছয়বছর ইতালিতে থাকার পর যোগ দেন ইয়োহান ক্রুইফের বার্সেলোনায়, ১৯৮৯ সালে। দৃশ্যপট পালটে গেল ভোজবাজির মত। শৈশবের হিরো’র কোচিং এ খেলতে থাকা লাউড্রপ যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন। রিস্টো স্টইচকভ, রোনাল্ড ক্যোম্যান, পেপ গার্দিওলাদের সাথে গঠন করলেন সেই “ড্রিম টিম”। জিতলেন ১১টি ট্রফি। লা লিগা, ইউরোপিয়ান কাপ, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, স্পানিশ কাপ, স্পায়নিশ সুপারকাপ – বাদ যায়নি কিছুই। ১৯৯৪ সালে চতুর্থ বিদেশী হিসেবে বার্সা দলে নিয়ে আসলো তখনকার উদীয়মান ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রোমারিওকে। অর্থাৎ এখন লাউড্রপ, স্টইচকভ, ক্যোম্যান, রোমারিওর মধ্যে যে কোন তিনজন খেলতে পারবেন মূল একাদশে। ১৯৯৪ সালের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের মূল একাদশে জায়গা হল না লাউড্রপের – তিনি ভাবলেন, ক্লাব ছাড়ার এইটাই সময়।
লাউড্রপ এখন প্রথিতযশা কোচ এখন। মায়োর্কা সোয়ানসি সিটি কোচিং করিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন কাতারি ক্লাব লেখউইয়ায়।
আর্জেন্টিনার অন্যতম বিশ্বস্ত এই ডিফেন্ডার ক্লাব ফুটবলে সেরকম সাফল্য কখনই পাননি। তবুও খেলে গেছেন ইউরোপের কিছু নামজাদা ক্লাবে। ১৯৯৫ সালে আর্জেন্টিনার যুবদল বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলে জুভেন্টাস আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স থেকে কিনে নেয় তাকে। কিন্তু ক্লাবের ট্যাকটিক্সের সাথে না যাওয়ায় মাত্র দুই ম্যাচ খেলেই শেষ হয়ে যায় সোরিনের জুভেন্টাস অভিযান। ২০০৩ সালের শীতকালীন দলবদলে সোরিন ক্রুজেইরো থেকে ধারে যোগ দেন বার্সেলোনায়। সেখানেও খেলেন আধা মৌসুমে সাকল্যে ১৫ ম্যাচ।

১৯৯৭ সালে এসি মিলানে একবছর ফ্লপ থাকার পর ৫.৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে শত্রুশিবির জুভেন্টাসে যোগ দেন ডাচ কিংবদন্তী এডগার ডাভিডস। জুভেন্টাসের হয়ে জিতেছেন সিরি আ, ইন্টারটোটো কাপ, ইতালিয়ান সুপারকাপ – বলতে গেলে সবকিছুই। জেতা হয়নি শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগই। ২০০৪ সালে ধারে যোগ দেন বার্সেলোনায়, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডের অধীনে ধুঁকতে থাকা বার্সাকে আধা মৌসুমেই ঝলক দেখিয়ে নিয়ে যান পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে।
ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী এই কিংবদন্তী ২০০১ সালে ৪১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পারমা থেকে যোগ দেন জুভেন্টাসে। জুভেন্টাসের ডিফেন্স ছিল তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা, থুরামের সাথে খেলতেন ফাবিও ক্যানাভারো, জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা, জোনাথান জেবিনা, ফেদেরিকো বালজারেত্তি, সিরো ফেরেরা, জিওর্জিও কিয়েল্লিনি, আইগর টিউডর – এরাও। জুভেন্টাসের হয়ে তিনবার জিতেছেন সিরি আ, জিতেছেন সুপারকোপাও। ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে জুভেন্টাস সিরি বি তে অবনমিত হলে ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে লিলিয়ান থুরাম যোগ দেন স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনায়। ২০০৬ সালে বার্সাতে যোগ দিয়ে সেরকম কিছু করতে পারেননি, একবার সুপারকোপা জেতা ছাড়া।
- থিয়েরি অঁরি
১৯৯৯ সালে ফরাসী ক্লাব মোনাকো ছেড়ে ১০.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন থিয়েরি অঁরি। আধামৌসুম জুভেন্টাসের উইংয়ে পড়ে থেকে অঁরি বুঝতে পারেন ইতালিয়ান ফুটবল তাঁর জন্য না – ফলাফল, আর্সেনালে পাড়ি। আর্সেনালে আট বছর কাটিয়ে আর্সেনালের কিংবদন্তী হয়ে ২০০৭ সালে অঁরি যোগ দেন বার্সায়, ২৪ মিলিয়ন ইউরো’র বিনিময়ে, যেখানে জেতেন তিনি সম্ভাব্য সবকিছুই।
ইতালির বিশ্বকাপজয়ী এই ডিফেন্ডার ১৯৯৯ সালে ৩১ মিলিয়ন ইউরো’র বিনিময়ে বারি থেকে যোগ দেন জুভেন্টাসে। রাইটব্যাল ও লেফটব্যাক উভয় পজিশানেই স্বচ্ছন্দে খেলা জামব্রোত্তা ২০০৬ বিশ্বকাপ জেতার পর যোগ দেন বার্সেলোনায়। থুরামের মতই, জুভেন্টাসে জিতেছেন প্রায় সবকিছুই, কিন্তু বার্সাতে সময় অত ভালো যায়নি।
জুভেন্টাসের ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে সিরি বি তে অবনমন হবার পরে থুরাম ও জামব্রোত্তার সাথে আরেকজনও তুরিন থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন অন্যত্র, তিনি সুইডিশ সুপারস্টার জলাতান ইব্রাহিমোভিচ। তিনি গেছিলেন শত্রুশিবির ইন্টারে। ইন্টার থেকে ২০০৯ মৌসুমে যোগ দেন বার্সেলোনায়, প্রায় ৭০ মিলিয়ন ইউরো’র বিনিময়ে, যদিও বার্সায় তেমন কিছু করতে পারেননি তিনি, যদিও একবছরে জিতেছেন সম্ভাব্য প্রায় সব ট্রফিই।
এই তালিকার একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি কিনা এখনো এই দুই ক্লাবের একটিতে খেলে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালে ভিয়ারিয়াল থেকে ১৬ মিলিয়ন ইউরো’র বিনিময়ে এই উরুগুইয়ান যোগ দেন বার্সেলোনাতে। কার্লেস পুয়োল, জেরার্ড পিকে, রাফায়েল মার্কেজের পর চতুর্থ পছন্দ ছিলেন তিনি বার্সায়, নিয়মিত ফুটবল খেলার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রথম দফা ধারে যোগ দেন জুভেন্টাসে। পরে বার্সা থেকে সেভিয়াতে পাকাপাকিভাবে যোগ দেওয়ার পর ২০১২ সালে আবার ধারে জুভেন্টাসে আসেন ক্যাসেরেস, এবার সেভিয়া থেকে জুভেন্টাস তাঁকে পাকাপাকিভাবেই কিনে নেয়। এখনো খেলে যাচ্ছেন তিনি জুভেন্টাসে, কে জানে, হয়তো নেমে পড়তে পারেন আজকেই, তাঁর সাবেক ক্লাব বার্সার বিপক্ষে!