
নেদারল্যান্ড। ফুটবল রূপকথার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ওলন্দাজদের কীর্তি-কাহিনী। ক্রুইফ-বাস্তেন-মিশেলস-বার্গক্যাম্পদের হল্যান্ড ফুটবলকে যা দিয়েছে তার লিস্টি করা শুরু করলে শেষ করা যাবেনা। কপাল খারাপ তাদের, বিশ্ব ফুটবলকে এত কিছু দেওয়ার পরেও এখনো পর্যন্ত সেই ২০১০ বিশ্বকাপ আর ১৯৭৪-১৯৭৮ এর ফাইনাল খেলা ছাড়া বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি ডাচদের।
ওলন্দাজ ফুটবলের এই বিশাল ঐতিহ্যের পিছে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তাদের ক্লাবগুলোর। আয়াক্স বলুন, বা পিএসভি আইন্দহোভেন, কিংবা এজেড আলকমার থেকে ফেইনুর্দ-এফসি টোয়েন্টে, উট্রেখট-হিরেনভিন – ডাচ ঐতিহ্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান এসব ক্লাবগুলোর খেলোয়াড় তৈরি করার, ভবিষ্যত প্রজন্মের সুপারস্টার তৈরি করার প্রবণতাটাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি ফুটবল বিশ্বের অসাধারণ সব সুপারস্টার তৈরি করা সত্ত্বেও সেই নব্বই দশকের ক্রুইফের আয়াক্স ছাড়া ডাচ ক্লাবগুলোর বলার মত কোন সাফল্যই নেই। কেন নেই? সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। লাখ টাকার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ডাচ ক্লাবগুলো তরুণ তারকা তৈরি করতে পারে ঠিকই, তারপর হয় ধরে রাখতে পারে না, অথবা নিজেরাই অধিক মুনাফায় তাদের বিক্রি করে দেয়। বছরের পর বছর ধরে এই সংস্কৃতিটাই চলে আসছে, নেদারল্যান্ডসের প্রত্যেকটা ক্লাবে।
কেমন হত যদি ডাচ ক্লাবগুলো তাদের সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি না করে দিয়ে নিজেদের ক্লাবে রাখত? আজকে দেখব নেদারল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব আয়াক্সের কাহিনী, যদি তারা নিজেদের সেরা খেলোয়াড়দের অন্য ক্লাবে বিক্রি না করে দিয়ে নিজেরাই রাখত, কি হত তাহলে। পুনশ্চঃ শুধুমাত্র সেসব খেলোয়াড়দেরকেই বিবেচনায় ধরা হয়েছে যারা আয়াক্স ছেড়ে ইতোমধ্যে চলে গেছেন/গিয়েছিলেন এবং এখনও খেলে যাচ্ছেন। মূল একাদশ সাজানো হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ডাচ ৪-৩-৩ ফর্মেশানে।
গোলরক্ষক : মার্টেন স্টেকেলেনবার্গ
১৯৯৭ সাল থেকে আয়াক্সের যুব অ্যাকাডেমিতে খেলা এই ডাচ গোলরক্ষক কিছুদিন আগ পর্যন্তও হল্যান্ডের নাম্বার ওয়ান ছিলেন, খেলেছেন কমলা জার্সিতে ৫৪ ম্যাচ। আয়াক্সের হয়ে দুইবার লিগ, তিনবার কাপ ও চারবার ইয়োহান ক্রুইফ শিল্ড জেতা এই খেলোয়াড় ‘আয়াক্স প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ হয়েছেন দুইবার। ২০১১ সালে ৬ মিলিয়ন ইউরোতে স্টেকেলেনবার্গ যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমায়।
রাইটব্যাক : গ্রেগরি ভ্যান ডার উইয়েল
আয়াক্সের যুব প্রকল্পের আরেক খেলোয়াড়, তিনি এখন ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে আছেন। ১৯৯৬ থেকে আয়াক্স পরিবারের সাথে যুক্ত উইয়েল আয়াক্সের জার্সিতে ১৩০ ম্যাচ খেলে ২০১২ তে যোগ দেন তৎকালীন নব্য ধনী ফরাসী ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে, ৬ মিলিয়ন ইউরোতে। বর্তমানে আরেক ডাচ রাইটব্যাক ডারিল ইয়ানমাটের সাথে নেদারল্যান্ডের মূল দলের রাইটব্যাক পজিশানের জন্য চলছে তাঁর স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। আয়াক্সের হয়ে লিগ তিনিও জিতেছেন দুইবার, কাপও দুইবার, ইয়োহান ক্রুইফ শিল্ড জিতেছেন একবার, আয়াক্স ট্যালেন্ট অফ দ্য ইয়ার হয়েছেন একবার, ডাচ ইয়াং ট্যানলেন্ট অফ দ্য ইয়ার হয়েছেন একবার।
সেন্টারব্যাক : থমাস ভার্মায়েলেন
বেলজিয়াম জাতীয় দলের বর্তমানের অন্যতম অপরিহার্য অংশ এই সেন্টারব্যাক ২০০৯ সালে ১২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আয়াক্স থেকে যোগ দেন আর্সেনালে। গত মৌসুমে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডের আর্সেনাল থেকে যোগ দিয়েছেন বার্সেলোনাতে। আয়াক্সের হয়ে ৯৭ ম্যাচ খেলে লিগ একবার, কাপ দুইবার ও ইয়োহান ক্রুইফ শিল্ড জিতেছেন দুইবার।
সেন্টারব্যাক : ইয়ান ভার্টঙ্ঘেন
বেলজিয়ান জাতীয় দলের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আয়াক্সের হয়ে ১৫৫ ম্যাচ খেলে দুইবার লীগ ও একবার কাপজয়ী এই সেন্টারব্যাক আয়াক্স প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার, ট্যালেন্ট অফ দ্য ইয়ার ও দাচ প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার হয়েছেন একবার করে। ২০১১ সালে ১৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন টটেনহ্যামে।
লেফটব্যাক : ডেলেই ব্লিন্ড
আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী, বর্তমান নেদারল্যান্ডসের কোচ কিংবদন্তী বাবা ড্যানি ব্লিন্ডের সন্তান ডেলেই ব্লিন্ড বর্তমানে আছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। আয়াক্সের হয়ে চারবার লিগ ও একবার শিল্ড জেতা এই লেফটব্যাক/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গতবছর হয়েছেন ডাচ ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার, একবার হয়েছেন আয়াক্স ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার। গতবছর ১৩.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার : নাইজেল ডি ইয়ং
বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ডেস্ট্রয়ার নাইজেল ডি ইয়ংকে আয়াক্স ২০০৬ সালে মাত্র ১ মিলিয়ন ইউরোতে ছেড়ে দিয়েছিল, ভাবা যায়? পরে সেই ইয়ংই ১৮ মিলিয়ন পাউন্ডের যোগ দেন ম্যানচেস্টার সিটিতে, এখন খেলছেন এসি মিলানে। ২০০৫ সালের আয়াক্স প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার এই ইয়ং একবার জিতেছেন লিগ, শিল্ডও জিতেছেন একবার।
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার : ওয়েসলি শ্নাইডার
তর্কযোগ্যভাবে আয়াক্সের ছেড়ে দেওয়া অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। আয়াক্সের হয়ে একবার লিগ, দুইবার কাপ ও চারবার শিল্ড জেতা শ্নাইডার ফিফা বর্ষসেরার তালিকায় চতুর্থও হয়েছিলেন একবার, ২০১০ বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জ বুট ও সিলভার বলও তাঁর দখলে, জিতেছেন অগণিত দলীয় ও একক পুরষ্কার। ২৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ২০০৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে শ্নাইডারকে ছেড়ে দেয় আয়াক্স, ইন্টারের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে এখন খেলছেন গ্যালাতাসারাইয়ে।
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার : রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট
বর্তমান যুগে আয়াক্সে অ্যাকাডেমি থেকে বের হয়ে আসা আরেক শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। আয়াক্সের হয়ে ১১৭ ম্যাচে ৫২ গোল করা এই মিডফিল্ডার তাদের হয়ে লিগ জিতেছেন দুইবার, কাপ ও শিল্ড একবার করে। ২০০৫ সালে মাত্র ৫.৫ মিলিয়ন ইউরোতে জার্মান ক্লাব হ্যামবার্গের কাছে ভ্যান দার ভার্টকে ছেড়ে দেয় আয়াক্স। পরে ১৩ মিলিয়ন ইউরোতে একসময়ের আয়াক্স সতীর্থ শ্নাইডারের সাথে রিয়াল মাদ্রিদে মিলিত হন তিনি। পরে টটেনহ্যামেও খেলেছেন তিনি, এখন আছেন রিয়াল বেটিসে।
অ্যাটাকার : ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন
বর্তমান ডেনমার্ক ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনও আয়াক্স অ্যাকাডেমি থেকে আসা। ২০১০ বিশ্বকাপের সবচেয়ে তরুণ খেলোয়াড় আয়াক্সের হয়ে তিনবার লিগ, একবার করে কাপ ও শিল্ড জেতা এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আয়াক্সে জিতেছেন অনেক ব্যক্তিগত শিরোপাও, টানা দুইবার জিতেছেন ড্যানিশ প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারের খেতাব। গত মৌসুমে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দেন টটেনহ্যাম হটস্পারে।
স্ট্রাইকার : লুইস সুয়ারেজ
উরুগুইয়ান সুপারস্টার লিভারপুল আর বার্সেলোনা মাতানোর আগে মাতিয়ে গেছেন আয়াক্স। আয়াক্সের হয়ে ১১০ ম্যাচে ৮১ গোল করা এই স্ট্রাইকার লিগ, কাপ ও শিল্ড জিতে গেছেন একবার করে, আয়াক্সের টপ স্কোরার হয়েছেন দুইবার, আয়াক্স ও ডাচ ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার হয়েছেন একবার করে, জিতেছেন আরও অসংখ্য ব্যক্তিগত পুরষ্কার।
স্ট্রাইকার : জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ
জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, এসি মিলান, পিএসজির এই কিংবদন্তীর শুরুটা কিন্তু আয়াক্সেই। আয়াক্সের হয়ে ৭৪ ম্যাচে ৩৫ গোল করা এই স্ট্রাইকার ২০০৪ সালে ১৬ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন জুভেন্টাসে। আয়াক্সের হয়ে লীগ জিতেছেন দুইবার, শিল্ড ও কাপ একবার করে, আর ব্যক্তিগত অর্জন – তা নিয়ে এখানে ক্যাচাল করা বাতুলতা বৈকি!
এ ত গেল মোটামুটি মূল একাদশ, এরকম বিক্রি করে দেওয়া খেলোয়াড় নিয়ে আয়াক্সের ২৩ জনের স্কোয়াডটা কিরকম হত দেখে নেওয়া যাক!

গোলরক্ষক –
মার্টেন স্টেকেলেনবার্গ
কেনেথ ভার্মেয়ার (ফেইনুর্দ)
বগদান লোবন্ত (এএস রোমা)
ডিফেন্ডার –
গ্রেগরি ভ্যান ডার উইয়েল
ইয়ান ভার্টঙ্ঘেন
থমাস ভার্মায়েলেন
ডেলেই ব্লিন্ড
টোবি অল্ডারউইয়েরেল্ড (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, সাউদাম্পটন, টটেনহ্যাম হটস্পার)
ম্যাক্সওয়েল (ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, পিএসজি)
জন হাইটিঙ্গা (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, এভারটন, ফুলহ্যাম)
ফিলিপে লুইস (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, দেপোর্তিভো লা করুনিয়া, চেলসি)
মিডফিল্ডার –
নাইজেল ডি ইয়ং
ওয়েসলি শ্নাইডার
রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট
ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন
রায়ান বাবেল (লিভারপুল, হফেনহেইম, কাসিমপাসা, আল আইন)
মিরালেম সুলেমানি (বেনফিকা, ইয়ং বয়েজ)
সিয়েম ডি ইয়ং (নিউক্যাসল ইউনাইটেড)
স্টিভেন পিনার (বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, এভারটন, টটেনহ্যাম হটস্পার)
ভার্নন আনিতা (নিউক্যাসল ইউনাইটেড)
স্ট্রাইকার –
ক্লাস ইয়ান হান্টেলার (রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, শালকে ০৪)

বুঝুন তাহলে, এই স্কোয়াড যদি আজকে আয়াক্সের থাকত, রিয়াল-বার্সা-বায়ার্ন এদের বেইল ছিল?