
খন্ডকালিন কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে দ্বৈরথ হয় না, চাই ধারাবাহিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে কেন জানি সেই ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকেই মনে হত বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথ প্রত্যাশা অমুলক কিছু নয়, শুধু আমাদের একজন ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক ওয়ালা নেতা আর তার পিছনে পর্দার আড়ালে একটি কার্যকর কোচিং স্টাফ চাই। ডেভ হোয়াটমোর- হাবিবুল বাশার আর জিমি সিডন্স-সাকিব আল হাসান- এই দুই জুটি বর্তমান বাংলাদেশ টিমের ভিত্তিপ্রস্তর এবং এতে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। হাবিবুল-ডেভ জুটি সর্বপ্রথম আমাদের জেতার প্রত্যাশা করতে শিখিয়েছিল।

২০০৫, ন্যাটওয়েস্ট ত্রিদেশীয় সিরিজ, বাংলাদেশ-অসট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড। রিকি পন্টিং এর দুর্বার অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড জয়রথ থামল হাবিবুলের বাংলাদেশের সামনে। নেতা হাবিবুল বাশার হয়ে উঠেন আমাদের সপ্ন-সারথি কেবলই তার নেত্রিত্তগুন আর সময়োপযোগী ধিরস্থির ব্যাটিং এর কল্যানে। ২০০৪ এ দেশের মাটিতে প্রথম ভারতকে হারানো, জিম্বাবুয়েকে তাদের ঘরে গিয়ে হারিয়ে আসা (২০০৪ সালেই), শাহরিয়ার নাফিস-মাশরাফি-আব্দুর রাজ্জাক ত্রয়ীতে ভর করে সাফল্যমন্ডিত একটি ২০০৬ সাল, আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে সপ্নের এক বিশ্বকাপ- এসবে মাঠের ভিতরের হাবিবুলের নেত্রিত্ত আর ড্রেসিং রুম কিংবা নেট প্র্যাকটিস এ ডেভের ভুমিকা ছিল অসাধারণ। তবে এখনকার মত তারায় ঠাসা ছিল না তখনকার বাংলাদেশ। বল হাতে বাশার ম্যাশ আর রফিক ভিন্ন অন্য কারও উপর বেশিরভাগ সময়েই আস্থা রাখতে পারতেন না। আর ব্যাটিং এ তৎকালীন লিটল জিনিয়াস খ্যাত আশরাফুল ছিলেন চরম অধারাবাহিক এক রাইজিং স্টার। এতদাসত্তেও হাবিবুল-ডেভ ঝুটি আমাদের প্রত্যাশাকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন শুধু তাদের অসাধারন রসায়ন আর নেত্রিত্তের কল্যানেই।
নতুন বলে ম্যাশের ভিতি জাগানিয়া এক পেসার হয়ে ওঠা, মোহাম্মদ রফিক উত্তর যুগে আব্দুর রাজ্জাকের বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্পিন আক্রমনের ঝান্ডাবাহি হয়ে ওঠা, শাহরিয়ার নাফিসে দীর্ঘদিনের ব্যাটিং ওপেনিং সমস্যা লাগবের স্বপ্ন বোনা, আর মিনি অলরাউন্ডার তত্ত্বে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়্ তথা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের আবিষ্কার- এসবের মুলে আপনি কোনভাবেই হাবিবুল-ডেভ ঝুটির অবদান অস্বীকার করতে পারবেন না। আর তাইতো, হাবিবুল উত্তর যুগে হৃদয় দিয়ে মিস করতাম তার বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্ড প্ল্যাসমেন্ট, বোলিং চেঞ্জ, আর সময়োপযোগী ফিফটিগুলি।
হাবিবুলের অবসর, হোয়াটমোরের চলে যাওয়া, আইসিএল কান্ড- সব মিলিয়ে টাল-মাটাল এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ফারস্ট স্টার মোহাম্মদ আশরাফুলের কাঁধে উঠলো অধিনায়কত্বের মত সব থেকে বড় দায়িত্বটি। কোচ হলেন আমার দেখা বিশ্বের সেরা ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স। তবে এ অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক সবচেয়ে বড় সমস্যাটা করেন আশরাফুলের ব্যাটিং ট্যাকনিক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। সিডন্সের শেখানো নতুন ব্যাকলিপ্টে আশরাফুলের অবস্থা হয়ে ওঠে বুড়ো বয়সে ক-খ শেখার মত। ফলাফল! ব্যাটিং এ আগের সহজাত ধার হারিয়ে ফেলতে থাকা আর স্বেচ্ছায় অধিনায়কত্ব ছাড়তে অপারগতা আশরাফুলকে ঠেলে দেয় ব্যাকফুটে। শুরু হয় ব্যাট হাতে একেবারে বিবর্ণ আশরাফুল অধ্যায়। সাথে কোচের বিষেদাগার। সব মিলিয়ে বিসিবি মাশরাফির কাঁধে ক্যাপ্টেন্সির ভার অর্পণের যায়গা খুজে পান। কিন্তু চোটের সাথে যার নিত্য সখ্য সেই ম্যাশ ই তার ক্যাপ্টেন্সির প্রথম টেস্ট ম্যাচেই পুনরায় ইঞ্জুরিতে পড়েন। ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান ঝুটি বাঁধেন সিডন্সের সাথে। সিডন্স-সাকিব ঝুটির রসায়নে বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন হালে পানি খুজে পায়।
বাংলাদেশের জিততে থাকা সিরিজগুলিতে সাকিবের ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হওয়া যেন অবধারিতই হয়ে উঠে। জাতীয় অঙ্গন ছাড়িয়ে সাকিব হয়ে বিশ্বসেরা ওডিয়াই অলরাউন্ডার। বছর খানেকের মধ্যে আবার টেস্ট ক্রিকেটেও। শুরুর দিকের ব্যাটসম্যান বা মিনি অলরাউন্ডার সাকিব পুরোদস্তুর স্পিনার হয়ে ওঠেন সেই আশরাফুলের ক্যাপ্টেন্সির সময়েই। অ্যাকশন সমস্যায় নিষিদ্ধ দেশের সেরা স্পিনার আব্দুর রাজ্জাকের অনুপস্থিতে ২০০৮ সালের বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ড প্রথম টেস্টটি শুরু হবার আগের দিনই কোচ মিডিয়ায় জানালেন স্পিন আক্রমনের মুল দায়িত্বভার বর্তাবে সাকিবের উপর।

সংশয় ছিল অনেক। তখনো সেভাবে স্পিনার হিসেবে পরিচিতি না পাওয়া সাকিব কি পারবেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে সাকিব সময় নিলেন মাত্র ১ ইনিংস। ২য় ইনিংসেই বাজিমাত। ৭/৩৭। বাংলাদেশের পক্ষে সেরা টেস্ট বোলিং পারফর্মেন্স। এর পরের টুকু আপনার আমার সবারই জানা। আমাদের একজনের বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার উপাখ্যান। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে ওডিয়াই সিরিজে ৩-২ এ হারার পর সাকিবের উপর থেকে চার্জ নিয়ে দেওয়া হয় মুশির উপর। ভাইস ক্যাপটেন তামিমের স্থলাভিষিক্ত হন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। মোটের উপর বিচার করলে সাকিব ছিলেন অসাধারন এক ক্যাপ্টেন। সিডন্সের সাথে ঝুটিটাও জমেছিল বেশ। তবে মাঠের ভিতরের শেষ ডিসিশান টা কেন জানি তার ফেভারে আসতো না। তাছাড়া রকিবুল কে কন্টিনিউয়াসলি খেলানো, বোর্ড সভাপতির অযাচিত রোষানলের স্বীকার, ২০১১ বিশবকাপে ম্যাশ কে না রাখা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক, আর মাঠের খানিকটা ম্রিয়মান সাকিব- সব মিলিয়ে ক্যাপ্টেন্সি যে হারাতে যাচ্ছিলেন তা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিলো। তবে সাকিব-সিডন্স অধ্যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেকটি সফল অধ্যায় ছিল সন্দেহাতীতভাবেই। সাকিবের এটাকিং ক্যাপ্টেন্সি সমাদৃত হয় দেশ-বিদেশের বিশ্লেষক দের নিকটও।

মুশি-রিয়াদের নেত্রিত্তে নব বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জয় দিয়ে। রবি রামপালের বলে লং অনের উপর দিয়ে বিশাল ছক্কা। অধিনায়কত্বে ওভিশেকের শুরুর দিকেই অমন একটি ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স জানান দিচ্ছিলো নতুন মুশির। ২০১২ সালে এশিয়া কাপে ইরফান পাঠান আর প্রভিন কুমারের উপর দিয়ে ঝড় তোলা মুশি নিশ্চিত করেন শচিনের শততম সেঞ্চুরির ম্যাচে বাংলাদেশের জয়।


কিন্তু ফাইনালে শেষ ফিনিশিং এর অভাবে প্রথম বারের মত এশিয়া কাপ জয় থেকে বঞ্চিত হয় ক্যাপ্টেন মুশি আর গোটা বাংলাদেশ। মুশফিকের ক্যাপ্টেন্সির সব থেকে ভালো লাগার দিক হলো গোটা টিম কে এক সুতোয় বাঁধতে পারার দক্ষতা যেটা আমরা সাকিব-সিডন্স যুগে খুব কমই দেখেছি। তবে বৈপরীত্যও রয়েছে। কথা বারতায় সাবলিল আর ভয়-ডর হীন মুশি যেমন ক্যাপ্টেন কারেজিয়াস উপাধিতে ভূষিত, ঠিক মাঠের ফিল্ড প্ল্যাসমেন্ট আর বোলিং চেঞ্জ এ ততটাই রক্ষণাত্মক মুশি। ব্যাট হাতে দলের সেরা প্লেয়ার যেমন মি. ডিফেন্ডেবল, মাঠের ভিতরের নেত্রিত্তে ঠিক উলটো- মি. ডিফেন্সিভ।

অর্থাৎ ক্যাপ্টেন কারেজিয়াস আর মি. ডিফেন্ডেবল উপাধির পাশাপাশি মি. ডিফেন্সিভ অপবাদও রয়েছে।
ট্যাকনিক্যালি দলের সেরা ব্যাটসম্যান। বৈরি সিচুয়েশনেও নিজের সহজাত এটাকিং ব্যাটিং এ ওস্তাদ। ৩০-৫০ বল খেলার মধ্য দিয়েও ব্যাবধান গড়ে দিতে সক্ষম। রয়েছে এশিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার সকল সম্ভাবনা। এমন একজনকে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ওয়ার্ল্ড কাপের আগে আগে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরিয়ে নেওয়া গত দশকে বিসিবি’র নেওয়া সেরা ডিচিশান গুলোর একটি নিশ্চই। আর সে যায়গায় দেশের ক্রিকেট ইতিহাশের সব থেকে যোগ্য নেতাকে বসিয়ে কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমি বাংলাদেশির মন জয় করে বিসিবি। ফলাফল? বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের ওয়ার্ল্ড কাপ ক্যাম্পেইন। ব্যাট হাতে আফগানিস্তান আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দূর্বার মুশি যেন সত্যিকারের ডিফেন্ডেবল। প্রতিদিনই যেন ব্যাট হাতে নিজেকে আরেকবার ছাড়িয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। এই হচ্ছেন আমাদের মুশফিক।

মাশরাফি-হাথুরেসিংহে-হিথ স্ট্রিক। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব থেকে সফল ঝুটি। হিথ স্ট্রিকের কাজের প্রমান ছান ? রুবেল, তাসকিন আর মোস্তাফিজের দিকে তাকান। বল হাতে এখনকার রুবেল হোসেন যতটা নিয়ন্ত্রিত আর ভয়ংকর, ততটা আপনি ২-৩ বছরের আগের রুবেলের মধ্যে নিশ্চই দেখেন নি।


মাত্র বছরখানেক তাস্কিনের অভিষেক হয় । অথচ চলমান বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে তাসকিন কে দেখে কতই না অভিজ্ঞ মনে হয়।

আর হাথুরেসিংহে? মাশরাফির ভাষায়, “কোচের ইনপুট গুলি আমদের জন্য অনেক অপরিহার্য।” আর হাথুরেসিংহেও পশংসার বানে ভাসান নেতাজী মাশরাফি বিন মরতুজাকে, “মাশরাফির মত ক্যাপ্টেন পেলে কোচের কাজ করার আর তেমন দরকার পড়ে না। মাঠে, ড্রেসিং রুমে সে সত্যিকারের নেতা। দলের সবার সেরা বের করতে সকল উপায় ই তার জানা। সবাই তাকে অনেক রেস্পেক্ট ও করে।” মাশরাফি ড্রেসিং রুমে থাকলে যে অন্যরকম আত্মবিশ্বাসী আবহের অবতারনা ঘটে সে আর নতুন বৈ কি।

পরিশেষে, ম্যাশ-হাথুরা-স্ট্রিক ত্রয়ীতে এ যেন বদলে যাওয়া এক নতুন বাংলাদেশ যা আগে কেউ কখনো দেখেন নি। এ এক দূর্বার বাংলাদেশ। তাইতো ভারতকে বাংলাওয়াশ করার সুযোগ ও আমাদের কাছে নিছক একটা সিরিজ জয় ছাড়া বেশি কিছু নয়। দলের প্লেয়ারদের চোখে মুখে নেই আগের মত উল্লাশে ফেটে পড়ার প্রবনতা।
সত্যিই, এগিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। বদলেছে ক্রিকেটারদের মানসিকতা। বাংলাদেশ-পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথ এখন বাস্তবতা। হাবিবুল-হোয়াটমোর, সাকিব-সিডন্স, কিংবা মুশি-রিয়াদ ঝুটি আমাদের যেটা স্বপ্ন দেখিয়েছিল, ম্যাশ-হাথুরা-স্ট্রিক ত্রয়ী আজ তার সফল বাস্তবায়ন করছে। এ ঝুটি অক্ষুন্য থাকুক নেক্সট ওয়ার্ল্ড কাপ পর্যন্ত।