
বিশ্বকাপ ২০১৮ চলে আসছে আস্তে আস্তে। সামনের মাসের ১৪ তারিখ থেকেই পর্দা উঠবে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞের। ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসরকে মাথায় রেখে এর মধ্যেই মূল দল ঘোষণা করা শুরু করে দিয়েছে সুযোগ পাওয়া বিভিন্ন দল। তবে দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী পরাক্রমশালী আর্জেন্টিনা কেন পিছিয়ে থাকবে? কোচ হোর্হে সাম্পাওলি বিশ্বকাপ কে মাথায় রেখে এরই মধ্যে ২৩ সদস্যের মূল আর্জেন্টিনা স্কোয়াড ঘোষণা করে দিয়েছেন। লিওনেল মেসি এর অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া আর্জেন্টিনা দলে মোটামুটি প্রত্যাশিত সকলই সুযোগ পেয়েছেন, দুই-একজন বাদে। এক নজরে দেখে নিন কে কে সুযোগ পেলেন এই স্কোয়াডে!
গোলরক্ষক
- ফ্র্যাঙ্কো আরমানি (রিভার প্লেট)
- উইয়ি ক্যাবায়েরো (চেলসি)
- নাহুয়েল গুজম্যান (টিগ্রেস)
ডিফেন্ডার
- হ্যাভিয়ের মাশচেরানো (হেবেই চায়না ফরচুন)
- নিকোলাস ওটামেন্ডি (ম্যানচেস্টার সিটি)
- ফেদেরিকো ফাজিও (এএস রোমা)
- গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো (সেভিয়া)
- ক্রিস্টিয়ান আনসালদি (তোরিনো)
- মার্কোস অ্যাকুনিয়া (স্পোর্টিং লিসবন)
- মার্কোস রোহো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
- নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকো (আয়াক্স আমস্টারডাম)
- এদুয়ার্দো সালভিও (বেনফিকা)
মিডফিল্ডার
- লুকাস বিলিয়া (এসি মিলান)
- এভার বানেগা (সেভিয়া)
- অ্যানহেল ডি মারিয়া (প্যারিস সেইন্ট জার্মেই)
- জিওভান্নি ল সেলসো (প্যারিস সেইন্ট জার্মেই)
- এনজো পেরেজ (রিভার প্লেট)
- ম্যাক্সিমিলিয়ানো মেজা (ইন্দিপেন্দিয়েন্তে)
- ক্রিস্টিয়ান পাভন (বোকা জুনিয়র্স)
স্ট্রাইকার
- লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা)
- সার্জিও অ্যাগুয়েরো (ম্যানচেস্টার সিটি)
- গঞ্জালো হিগুয়াইন (জুভেন্টাস)
- পাওলো ডিবালা (জুভেন্টাস)
দলে সুযোগ হয়নি যাদের
- মাউরো ইকার্দি (ইন্টার মিলান)
- লিয়ান্দ্রো পারেদেস (জেনিত সেইন্ট পিটার্সবার্গ)
- ইজেক্যিয়েল গ্যারায় (ভ্যালেন্সিয়া)
- সার্জিও রোমেরো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
- অগাস্টিন মার্চেসিন (ক্লাব আমেরিকা)
- জিরোনিমো রুইয়ি (রিয়াল সোসিয়েদাদ)
- রামিরো ফ্যুনেস মোরি (এভারটন)
- ফাব্রিসিও বুস্তোস (ইন্দিপেন্দিয়েন্তে)
- গ্যিদো পিজারো (সেভিয়া)
- ডিয়েগো পেরোত্তি (সেভিয়া)
- অ্যানহেল কোরেয়া (অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ)
- জোয়াক্যুইন কোরেয়া (সেভিয়া)
- লওতারো মার্টিনেজ (রেসিং)
গত দুই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এর অবিসংবাদিত নাম্বার ওয়ান গোলরক্ষক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সার্জিও রোমেরোর এবারও এক নাম্বার গোলপ্রহরী থাকার কথা। কিন্তু ট্রেনিং করতে গিয়ে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছেন তিনি। ফলে এবার গোলবারের নিচে মূল একাদশে সম্পূর্ণ নতুন একজন গোলরক্ষক দেখবেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা – রিভার প্লেটের হয়ে সুপারকোপা জেতা ফ্র্যাঙ্কো আরমানিরই মূল গোলরক্ষক থাকার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী। আর্জেন্টিনা দলে অন্যান্য গোলরক্ষকের মধ্যে রয়েছেন চেলসির উইয়ি ক্যাবায়েরো, আর রোমেরোর পরিবর্তে স্কোয়াডে ডাকা হয়েছে টিগ্রেসের নাহুয়েল গুজম্যানকে। ইনজুরিতে না পড়লে তিন বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার মূল গোলরক্ষক হবার দুর্লভ কৃতিত্ব গড়তেন রোমেরো, যে কৃতিত্ব আর কারোরই নেই। বর্তমানে উবালদো ফিলোল (১৯৭৮ ও ১৯৮২), নেরি পুম্পিদো (১৯৮৬ ও ১৯৯০) ও সার্জিও রোমেরো (২০১০ ও ২০১৪) – প্রত্যেকেই দুটো করে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের মূল গোলরক্ষক থেকেছেন। বর্তমানে আর্জেন্টিনা দলের তিন গোলরক্ষকের মধ্যে নাহুয়েল গুজম্যানেরই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা সবচাইতে বেশী, এ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে ৬ ম্যাচ খেলেছেন তিনি, ক্যাবায়েরো খেলেছেন ২ ম্যাচ, আর এখনো আর্জেন্টিনার হয়ে মাঠেই নামা হয়নি আরমানির। যদিও বাকী দুইজনের থেকে এই বিশ্বকাপে এখন আরমানিরই মূল একাদশে থাকার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী। রিভার প্লেটের এই গোলরক্ষক গত দুই মৌসুম থেকেই দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। রিভার প্লেটের হয়ে গত ২০ ম্যাচে ১২টা ক্লিন শিট (গোল না খেয়ে ম্যাচ শেষ করা) রাখা এই গোলরক্ষকই হচ্ছেন আর্জেন্টিনার নতুন নাম্বার ওয়ান। এর আগে আর্জেন্টিনা যে দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছে, ১৯৭৮ (উবালদো ফিলোল) ও ১৯৮৬ (নেরি পুম্পিদো) সালে, প্রত্যেকবারই আর্জেন্টিনা দলের মূল গোলরক্ষক রিভারপ্লেট ক্লাবের খেলোয়াড় ছিল। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের মূল গোলরক্ষক উবালদো ফিলোল তো আবার ঐ বিশ্বকাপের আসরেই জাতীয় দলের হয়ে অভিষিক্ত হয়েছিলেন! একই জিনিস এবার ঘটতে যাচ্ছে ফ্র্যাঙ্কো আরমানির হয়েও, যদি তিনি আসলেও আর্জেন্টিনা দলের নতুন নাম্বার ওয়ান গোলরক্ষক হন!

এই বিশ্বকাপ এর অন্যতম আলোচিত বিষয় হতে যাচ্ছে কোচ হোর্হে সাম্পাওলির ফর্মেশন। বিভিন্ন ফর্মেশনে তিনি এখনো তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন স্কোয়াডের সাথে। তবে এ পর্যন্ত ৩-৪-৩ ফর্মেশনকেই বিভিন্ন ম্যাচে প্রাধান্য দিয়েছেন এই কোচ। মাঝে মাঝে খেলিয়েছেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশনেও। তবে স্পেইনের সাথে বিধ্বস্ত হওয়া ম্যাচে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলানোর কারণে এই ফর্মেশনে আর নাও ফিরতে পারেন সাম্পাওলি। সেক্ষেত্রে আর্জেন্টিনা কোচের মূল ফর্মেশন হতে যাচ্ছে ৩-৪-৩ বা ৩-৩-৩-১, যা আক্রমণের সময়ে ২-৩-৩-২ হয়ে যাবে, এটা সাম্পাওলি নিজেই উল্লেখ করেছেন। আক্রমণের সময়ে ২-৩-৩-২ ফর্মেশনে খেলা মানে রক্ষণের সময় ৪-১-৩-২ হয়ে যাওয়া। তাই বলা যেতে পারে, আর্জেন্টিনা দলের মূল ফর্মেশন এবারের বিশ্বকাপে হতে যাচ্ছে ৪-১-৩-২ ও ৩-৪-৩। এই টিম প্রিভিউ তে আমরা দুটো ফর্মেশন নিয়েই আলোচনা করব।
- ৪-১-৩-২/২-৩-৩-২ ফর্মেশনের ক্ষেত্রে :
যথারীতি মূল গোলরক্ষক থাকছেন ফ্রাঙ্কো আরমানি। দুই সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলবেন অভিজ্ঞ হ্যাভিয়ের ম্যাশচেরানো ও এবার ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে লিগ জেতা নিকোলাস ওটামেন্ডি। এই ফর্মেশনে ব্যাকআপ সেন্টারব্যাক হিসেবে দলে থাকছেন এএস রোমার ফেদেরিকো ফাজিও এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মার্কোস রোহো, যদিও রোহো মূলত আর্জেন্টিনা দলে লেফটব্যাক হিসেবেই খেলে থাকেন। ৪-১-৩-২ ফর্মেশনটা আক্রমণের সময় ২-৩-৩-২ হয়ে যাওয়ার অর্থ দলে মোটামুটি আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফুলব্যাক লাগবে। তাই এই ফর্মেশনে ফুলব্যাকের ভূমিকায় থাকতে পারেন ডানদিকে সেভিয়ার গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো আর বামদিকে আয়াক্সের নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকো। দলে সেরকম স্পেশালিস্ট রাইটব্যাক নেই দেখেই মের্কাদোকে এই দলের রাইটব্যাকের ভূমিকা দিতে হবে। মের্কাদো ক্লাবে সেন্টারব্যাক/রাইট উইংব্যাক (৩-৪-৩) ফর্মেশনে, রাইটব্যাক (৪ জনের ডিফেন্সের যেকোন ফর্মেশনে) ইত্যাদি খেলে থাকেন, আবার খেলতে পারেন লেফটব্যাক হিসেবেও। রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক পজিশনে দলে নেওয়া হয়েছে বেনফিকার এদুয়ার্দ সালভিওকে। যদিও ক্লাব জীবনে সালভিও মূলত একজন রাইট উইঙ্গার। রাইটব্যাক হিসেবে আর্জেন্টিনা দলে মের্কাদো-সালভিওর উপস্থিতি দলে রাইটব্যাকের আকালকেই চিৎকার করে প্রকাশ করছে যেন!

সেটা বললাম, এই ফর্মেশনে লেফটব্যাক হিসেবে সাম্পাওলির মূল পছন্দ আয়াক্সের নিকোলাস তাগ্লিয়াফিকো। দলে তাঁর ব্যাকআপ হিসেবে রয়েছেন স্পোর্টিং লিসবনের মার্কাস অ্যাকুনিয়া। যদিও সালভিও আর অ্যাকুনিয়ার সমস্যা মূলত একই। ক্লাবে অ্যাকুনিয়া লেফট উইঙ্গার হিসেবেই খেলে থাকেন, জাত লেফটব্যাক নন তিনি। দুই ফুলব্যাক পজিশনে এই স্পেশালিস্টের অভাবের কারণেই বোধকরি ইতালির ক্লাব তোরিনোর সব্যসাচী ফুলব্যাক ক্রিস্টিয়ান আনসালদিকে ধরে এনেছেন সাম্পাওলি। ডান-বাম উভয়দিকেই ফুলব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন তিনি।
৪-১-৩-২/২-৩-৩-২ ফর্মেশনে দলে একজন কার্যকরী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার থাকা বাঞ্ছনীয়। দুর্ভাগ্যবশত এই পজিশনে আর্জেন্টিনার হয়ে যে খেলেন তাঁকে কোনভাবেই উক্ত পজিশনে বিশ্বের সেরাদের কেউ নন। এই পজিশনে খেলার জন্য দলে রাখা হয়েছে এসি মিলানের লুকাস বিলিয়াকে। আর তাঁর ব্যাকআপ হিসেবে দলে আলাদা কোন খেলোয়াড়কে নেওয়া হয়নি। কোন সমস্যা হলে বিলিয়ার জায়গায় খেলানো হবে হ্যাভিয়ের মাশচেরানোকে, আর ম্যাশচেরানোর জায়গায় তখন দলের সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলবেন ফেদেরিকো ফাজিও।

এবার আসা যাক দলের তিনজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ব্যাপারে (রাইট উইঙ্গার, লেফট উইঙ্গার, সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার)। লেফট উইঙ্গার হিসেবে দলে থাকার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী অ্যানহেল ডি মারিয়ার। সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের আরেক মিডফিল্ডার জিওভান্নি ল সেলসো, আর ওদিকে রাইট উইঙ্গার হিসেবে থাকতে পারেন জুভেন্টাসের পাওলো ডিবালা, ইন্দিপেন্দিয়েন্তের ম্যাক্সিমিলিয়ান মেজা ও বোকা জুনিয়র্সের ক্রিস্টিয়ান পাভনের মধ্যে যেকোন একজন – কেননা এই পজিশনে খেলার কথা যার ছিল সেই ম্যানুয়েল লানজিনি হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে দল থেকে ছিটকে গেছেন।
৪-১-৩-২/২-৩-৩-২ ফর্মেশনে দলে খেলবেন দুই স্ট্রাইকার, একজন মূল টার্গেটম্যান, আরেকজন সহকারী স্ট্রাইকার যিনি একটু নিচে নেমে মূল স্ট্রাইকারকে সহযোগিতা করবেন। মূল স্ট্রাইকারের দায়িত্ব থাকতে পারেন গঞ্জালো হিগুয়াইন বা সার্জিও অ্যাগুয়েরোর মধ্যে যেকোন একজনের উপর, আর সহকারী স্ট্রাইকার হিসেবে অতি অবশ্যই দলে থাকছেন দলের অধিনায়ক, বিশ্বসেরা খেলোয়াড় লিওনেল অ্যান্দ্রেস মেসি। দলে ব্যাকআপ স্ট্রাইকার হিসেবে রয়েছেন দ্বিতীয় মেসি খ্যাত – পাওলো ডিবালা।
- ৩-৪-৩ ফর্মেশনের ক্ষেত্রে
এক্ষেত্রে তিনজন সেন্টারব্যাক অবশ্যই লাগবে, বুঝতেই পারছেন। আর্জেন্টিনা দলে এই তিনজন হবেন ম্যাশচেরানো, ওটামেন্ডি আর ফাজিও। রাইট উইংব্যাক হিসেবে মের্কাদো, লেফট উইংব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন মার্কাস অ্যাকুনিয়া। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে জুটি বাঁধতে পারেন লুকাস বিলিয়া ও জিওভান্নি ল সেলসো। স্ট্রাইকার হিসেবে গঞ্জালো হিগুয়াইন বা সার্জিও অ্যাগুয়েরোর একজনকে রেখে দুইপাশে খেলবেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি ও অ্যানহেল ডি মারিয়া। দলে তুরুপের তাস হিসেবে বেঞ্চ থেকে বাজিমাত করতে পারেন পাওলো ডিবালা কিংবা ক্রিস্টিয়ান পাভন।

এবারই বলতে গেলে একরকম আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জিতার শেষ সুযোগ। তর্কযোগ্যভাবে আর্জেন্টিনা ইতিহাসের সবচাইতে সেরা খেলোয়াড় এ পর্যন্ত সম্ভাব্য প্রায় সবকিছু জিতলেও জাতীয় দলের হয়ে ম্যারাডোনা বা কেম্পেসের মত কোন ট্রফি জেতেননি, বিশ্বকাপ জয় তো দূরের কথা। গতবার ফাইনালে উঠলেও শেষ মুহূর্তের খাওয়া গোলে জার্মানিকে বিজয়োল্লাস করতে দেখেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি।

তবে এবার কি অপেক্ষা ফুরোনোর পালা? দেখা যাক!
স্কোয়াড প্রিভিউ দেখুন আরও –